রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে পাবনার বাধেরহাট থেকে খয়েরচর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কে মেলেনি সুফল। সড়ক নির্মাণের পর কাজিরহাট ফেরিঘাটকে রাজবাড়ীর খয়েরচরে স্থানান্তরের কথা থাকলেও দীর্ঘ ৯ বছরেও সেটি হয়নি। উলটো নির্মিত সড়কটি খানাখন্দে ভরে গেছে। এদিকে পূর্বের নির্মিত সেই সড়ক ফেরিঘাট স্থানান্তরে উপযুক্ত না হওয়ায় নতুন করে সড়কের দৈঘ্য-প্রস্থ বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ৯৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা করা হয়েছে। ফলে পূর্বের প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে ৯ বছর ধরে দুর্ভোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যমুনা সেতু হয়ে পাবনার দূরত্ব প্রায় ২৩৩ কিলোমিটার। কাজিরহাট-আরিচা নৌপথ হয়ে এ দূরত্ব ১৪৭ কিলোমিটার। কাজিরহাট ফেরীঘাট থেকে আরিচা যেতে নৌপথে প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। ফেরি পারাপারে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগায় অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দ্রুতগতির স্পিডবোটে যাতায়াত করছেন।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালে পাবনার আমিনপুর থানার বাধেরহাট থেকে ঢালারচরের রাখালগাছি পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণ করে পাবনা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কাজিরহাট ফেরিঘাটকে খয়েরচরে স্থানারের মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণের অন্তত ১০ জেলার দূরত্ব কমানো। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের নির্মাণ কাজের ফলে ৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প আলো ছড়াতে পারেনি। উদ্বোধনের আগেই সড়কের পিচ উঠে খানাখন্দে পরিণত হয়। বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সড়কটি। ফলে সুফলের পরিবর্তে আগের দুর্ভোগই পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজে এমন অনিয়মের অভিযোগ যাচাইয়ে সেসময় তদন্ত কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মেলায় জামানতও বাজেয়াপ্ত করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির। পরে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি আর জানা যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাধেরহাট থেকে ১১ কিলোমিটার সড়কের অধিকাংশ জায়গায়ই পিচ উঠে বেহাল অবস্থা। সড়কের দুই ধার ভেঙে সরু হয়ে গেছে। বড় যানবাহন তো দূরে থাক, ছোট যানগুলো চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সড়কটি। খানাখন্দে পড়ে প্রতিনিয়তই নানাধরণের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন চালক ও যাত্রীরা। প্রসূতি বা অন্যান্য রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার মতো অবস্থা নেই সড়কটির। এদিকে এ সড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হলে অর্থাৎ কাজিরহাট ফেরিঘাটকে খয়েরচরে স্থানান্তর করা হলে ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব ও যাত্রার সময় কমবে। এতে এ অঞ্চলসহ পাবনা ও অন্যান্য অন্তত ১০ জেলার অর্থনৈতিক গতি বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত এ সড়ক সংস্কার করে ফেরীঘাট স্থানান্তরের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ঢালারচরের পাইকান্দা গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী ও ভ্যানচালক রশিদ বলেন, সে সময় আমাদের বলা হলো, এই রাস্তা হলে এর মাথায় ফেরীঘাট হবে। এ এলাকার উন্নয়ন হবে। আমরা জমিজমা দিলাম। সেগুলোর টাকা-পয়সা কিছুই পাইনি। কিন্তু সে ফেরীঘাট আর হলো না। আবার বড় গাড়ি তো দূরে থাক ছোট ভ্যান, রিকশা বা ইজিবাইকও চলতে পারে না। বৃষ্টি হলে একদমই চলা যায় না। এই রাস্তা ভালো হলে আর ঘাটটা এদিকে এলে বিভিন্ন ফসল আমরা সরাসরি ঢাকা বা অন্য জায়গায় নিয়ে ভালো দাম পেতাম।

একই এলাকার শিপন ইসলাম বলেন, এই সড়কটি হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। কাজিরহাট ফেরিঘাটকে দক্ষিণ বা ভাটিতে ১৪ কিলোমিটার নিয়ে গিয়ে খয়েরচরে ফেরিঘাট সংযুক্ত করা। পরে এ নিয়ে বারবার শুনছি সড়কের দুইপাশ প্রশস্ত করে আরও কাজ হবে। কিন্তু আজও এটি আলোর মুখ দেখেনি। সে সময়ে সড়কের কাজ যেভাবে করা হয়েছে তা আর বলা যায় না। একদমই বাজে কাজ করে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
গোয়াল নগর বাজার এলাকার দোকানি বিল্লাল চৌধুরী ও ভ্যানচালক হাশেম বলেন, রাস্তা খারাপ হওয়ায় এখন আর গাড়ি আসে না। ভ্যান চালানো যায় না, চাকা বসে যায়। রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া যায় না। এই রাস্তাটা ভালো হলে আমাদের উপকার হয়। আর ঘাট এখানে হলে এই অঞ্চলে অনেক গরীব মানুষ আছে তাদের জন্য খুবই উপকার হয়।
বেড়া থেকে প্রাইভেটকারে ঢাকায় যাচ্ছিলেন রফিকুল ইসলাম। কাজিরহাট ফেরিঘাটে ফেরির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আলাপকালে তিনি বলেন, ফেরির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আসবে, লোড হলে ছাড়বে। এরপর নদী পার হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার কেটে যাবে। সেখানে ২০ মিনিটে নদী পার হতে পারলে ভোগান্তি কমবে। সময় বাঁচবে এক থেকে দেড়ঘণ্টা। তাহলে সেটাই তো ভালো। এজন্য কর্তৃপক্ষকে বলবো, দ্রুতই ঘাটকে স্থানান্তর করে যাত্রা সহজ করা হোক।

সওজ সূত্রে জানা যায়, প্রথম ধাপে হাতে নেওয়া প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ায় ঘাট স্থানান্তর সম্ভব না হওয়ায় সম্প্রতি ৯৭৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা করেছে সড়ক বিভাগ। এর আওতায় পূর্বের ১১ কিলোমিটারসহ রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার খয়েরচর পর্যন্ত মোট ১৫ দশমিক ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। সেখানে স্থানান্তর করা হবে কাজিরহাট ফেরিঘাটকে। এ সড়ক প্রশস্তের পাশাপাশি এর আওতায় নির্মাণ হবে দুইটি বড় ব্রিজ ও সাতটি আরসিসি কালভার্ট। এর জন্য ৩৬ দশমিক ৫৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করবে সড়ক বিভাগ। এর আগে সড়ক বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন একটি মহল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনও করেছেন।
নতুন প্রকল্প নিয়ে সওজ কর্তৃপক্ষ বলছে, পূর্বের ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের সময়ই পরিকল্পনা ছিল সেই সড়ক শেষে নতুন প্রকল্পে আবারও চার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর পর স্থানান্তর হবে ফেরিঘাট। সেই সড়কটি দীর্ঘদিন হয়নি, নতুন প্রকল্প পেলে শুরু হবে। ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পর দীর্ঘ ৯ বছরেও নতুন প্রকল্প না নেওয়ার কারণ অনুসন্ধান করলেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন পাবনা সওজের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাদেকুর রহমান।
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাদেকুর রহমান বলেন, পূর্বের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ই পরিকল্পনা ছিল বাধেরহাট থেকে রাখালগাছি পর্যন্ত কাজ হওয়ার পর আরেকটি নতুন প্রকল্প নিয়ে সেখান থেকে খয়ের চর পর্যন্ত আরো চার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করে সেখানে ফেরীঘাট স্থাপন করার। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা জটিলতায় সেটি এতদিনেও সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পের সুফল পায়নি কেউই।
তিনি আরও বলেন, প্রায় নয় বছরে পূর্বের করা সড়ক অনেকাংশে নষ্ট হওয়ায় এখন নতুন করে বাধেরহাট থেকে খয়েরচর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও ফেরীঘাট স্থানান্তরের প্রকল্প প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কপথে ৮৬ ও নৌপথে প্রায় ১১ কিলোমিটার কমবে। এর ফলে বৃহত্তর রাজশাহী, নাটোর ও পাবনাসহ এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক বিপ্লব ঘটবে। এ উদ্দেশ্যেই আমরা প্রকল্পটি হাতে নিয়েছি। প্রকল্পটির ওপর এরই মধ্যে যাচাই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে কিছু জিজ্ঞাসা এসেছে, সেগুলো আমরা মিটআপ করে পুনরায় ডিপিপি প্রেরণের ব্যবস্থা নিচ্ছি।