সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন যেমন দ্রুত তথ্য পৌঁছানোর মাধ্যম, তেমনি ভুল তথ্য ছড়ানোর ভয়ংকর প্ল্যাটফর্মেও পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার) কিংবা টিকটক— প্রতিদিনই এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা গুজব, বিকৃত তথ্য এবং উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট। এসব তথ্যের অনেকগুলোই যাচাই-বাছাই না করে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে নিচ্ছেন, ফলে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং সামাজিক উত্তেজনা।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়, দেশের কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ভিডিওটি শেয়ার, মন্তব্য আর রিঅ্যাকশনে ভেসে গেছে মুহূর্তেই। অথচ ভিডিওটির কোনও সত্যতা ছিল না, ছিল না কোনও নির্ভরযোগ্য উৎস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিডিওটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনমনে ভীতি তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল করা।
এ ধরনের গুজব শুধু অর্থনৈতিক খাতেই নয়, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এমনকি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়েও প্রতিনিয়ত ছড়ানো হচ্ছে নানা ভুল তথ্য। ‘কোনও এক তারকা মারা গেছেন’—এমন গুজব অথবা ‘কোনও নতুন ওষুধ খেলেই সারবে করোনা‘, আবার কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ঘিরে এমন মিথ্যা তথ্য বহু মানুষ বিশ্বাস করে ফেলছেন।
সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত, কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৫২) বলেন, ‘ফেসবুকে দেখলাম এক জায়গায় নাকি খুব সস্তায় গ্যাস-চালিত কুকার বিক্রি হচ্ছে। আমি অর্ডার দিই, কিন্তু পরে দেখি পেজটা হাওয়া! ৩ হাজার ৫০০ টাকা চলে গেলো।’
আবার তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘গত কিছু দিন ধরে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ফটোকার্ড দেখছি। এখন কোনটা বিশ্বাস করবো, আর কোনটা বিশ্বাস করবো না। এ নিয়ে আমি নিজেই নানা বিভ্রান্তিতে আছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হয়েও ভুল তথ্যে ঢুকে যাই। আর সাধারণ মানুষ কী করবে?’
মনোয়ারা বা সাবিনার মতো হাজারও মানুষ প্রতিদিন নানা গুজব ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, যার বেশির ভাগই হয় ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, পোস্ট বা ফটোকার্ডের মাধ্যমে।
প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বাড়ছে চ্যালেঞ্জ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা বলেন, ‘আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে এমন সব রিয়েলিস্টিক ভিডিও বানানো সম্ভব, যেগুলো দেখে আসল নাকি নকল বোঝা প্রায় অসম্ভব। ফলে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। ফলে সরকারের উচিত একটি কেন্দ্রীয় ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট গঠন করা। অন্যান্য দেশে ভুল তথ্য যাচাইয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের ভুল তথ্য যাচাই করে সঠিক তথ্য জানানো হয়। সরকার এমন উদ্যোগ নিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি জোরদার করা যাবে। একইসঙ্গে যারা গুজব ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।’
সাধারণ মানুষকে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তানভীর জোহা বলেন, ‘অনলাইন মানেই একটি প্রতারণার জায়গা। সেখানে নানারকম চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়। ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানে ঠকার পরও মানুষ অনলাইনে নানা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। ফলে যেকোনও কিছু জেনে-বুঝে ব্যবহার করতে হবে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাই করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম বলেন, ‘বর্তমানে অনলাইনে ভুল তথ্য ও গুজবের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অসত্য বা বিকৃত তথ্য সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে এবং কখনও কখনও সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। একটি মিথ্যা পোস্টের কারণে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি হুমকির মুখে পড়তে পারেন, আবার কোনও ভুয়া ছবি বা ক্যাপশন দিয়ে পুরো সমাজকে বিভ্রান্ত করা যায়—এটি এখনই রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
ফেসবুক-ইউটিউবের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোও দায় এড়াতে পারে না। অনেক সময় বারবার রিপোর্ট করার পরেও কোনও গুজব বা ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানো হয় না। বরং ‘এনগেজমেন্ট’ বাড়ানোর জন্য অ্যালগরিদম সেগুলো আরও বেশি মানুষকে দেখাতে থাকে।
অপতথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
গত ২ জুলাই এক সভায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অপতথ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য শুধু জনমতকে বিভ্রান্ত করে না, বরং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তিকেও বিঘ্নিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অপতথ্য প্রতিরোধে কেবল রাষ্ট্র নয়, সাধারণ মানুষেরও সচেতন ভূমিকা থাকতে হবে। গণমাধ্যম, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই একটি টেকসই ও নৈতিক তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।’
সমাধান কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যার সমাধান ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রসহ সব স্তরের সম্মিলিত উদ্যোগে সম্ভব। বিশেষ করে ব্যবহারকারীদের তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়তে হবে। সরকারি পর্যায়ে দ্রুত ফ্যাক্টচেক ও জনসচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে। এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকেও দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্যের এই যুগে ভুল তথ্যই এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। বিভ্রান্তি তৈরি করে সমাজে বিভাজন, বিশৃঙ্খলা ও ক্ষতি ডেকে আনছে। তাই সময় এসেছে ‘তথ্য’ নয়, ‘সত্য’ যাচাই করার। ‘শেয়ার’ দেওয়ার আগে একাধিকবার ভাবতে হবে এটি কোনও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে কিনা নাকি কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য এই তথ্য?
ঢাবি শিক্ষক ড. খোরশেদ আলমের মতে, ‘এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জনগণকে তথ্য যাচাইয়ে সচেতন হতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতর্কতা ও মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকার, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ভুল তথ্য ছড়ালে শুধু অনলাইন নয়, বাস্তব জীবনেও তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে—এ কথা সমাজকে বুঝতে হবে এখনই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘বর্তমান ডিজিটাল যুগে তথ্য যাচাই (ফ্যাক্ট-চেকিং) ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি অত্যন্ত জরুরি। গুজব ও অপতথ্য রোধে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য চিনে নিতে পারে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত ও রিপোর্ট করা, বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার এবং এআই প্রযুক্তি দিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করাও এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে সাইবার অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ, অনলাইনে নজরদারি এবং কমিউনিটি পর্যায়ে রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করতে হবে।’
তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ‘ডিজিটাল নাগরিকতা’ ও ‘তথ্য বিশ্লেষণ’ শিক্ষা চালু করলেই মিডিয়া লিটারেসি বাড়বে—যা গুজব প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।