১০:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ৪ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চীনা নজরদারি নিয়ে ভারতের উদ্বেগে সিসিটিভি শিল্পে অস্থিরতা

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৬:৩৫:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • ২৮ Time View

বিশ্বজুড়ে নজরদারি প্রযুক্তি নির্মাতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত। এর মূলে রয়েছে একটি নতুন নিরাপত্তা নীতি। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সিসিটিভি নির্মাতাদের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সোর্স কোড ভারত সরকারের পরীক্ষাগারে জমা দিতে হবে অনুমোদনের জন্য। বিষয়টি নিয়ে বৈশ্বিক সিসিটিভি বাজারে তৈরি হয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা।

ভারতের এ পদক্ষেপ মূলত চীনা প্রযুক্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ থেকেই এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ ভারতীয় নীতিনির্ধারক। রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২১ সালে ভারতের তৎকালীন আইটি প্রতিমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত ১০ লাখ সিসিটিভির বেশিরভাগই ছিল চীনা কোম্পানির এবং ভিডিও তথ্য বিদেশি সার্ভারে পাঠানোয় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল।

চলতি বছরের ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন নিয়ম অনুযায়ী, চীনের হিকভিশন, দাহুয়া ও শাওমি, দক্ষিণ কোরিয়ার হানহোয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মটোরোলা সল্যুশনসসহ সব নির্মাতাকে ভারতের পরীক্ষাগারে ক্যামেরা জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। এটি সব ধরনের ইন্টারনেট-সংযুক্ত ক্যামেরার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ভারতের সাবেক সাইবার নিরাপত্তা প্রধান গুলশন রাই রয়টার্সকে বলেন, ইন্টারনেট-সংযুক্ত সিসিটিভি ক্যামেরা দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ঝুঁকি সবসময় থেকেই যায়। সেগুলো যথেষ্ট সুরক্ষিত ও শক্তপোক্ত না হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতের কর্মকর্তারা দেশি-বিদেশি ১৭টি নজরদারি প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে হানহোয়া, মটোরোলা, বোশ, হানিওয়েল ও শাওমির প্রতিনিধিরা জানান, তারা নতুন নিয়মের জন্য প্রস্তুত নন এবং বাস্তবায়ন বিলম্বিত করার অনুরোধ করেন। তবে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি একটি বাস্তব নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যু এবং সময়ক্ষেপণ করা যাবে না।

ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, এই নিয়ম কোনও নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে নয়। বরং দেশের নজরদারি ব্যবস্থার গুণমান ও সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নির্মাতাদের অভিযোগ—পর্যাপ্ত পরীক্ষাগার না থাকা, কারখানা পরিদর্শনে বিলম্ব এবং সোর্স কোড পর্যালোচনার জটিলতার কারণে অনুমোদন পেতে বিলম্ব হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

হানহোয়ার দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক অজয় দুবে ৯ এপ্রিল মন্ত্রণালয়কে এক ই-মেইলে লিখেছেন, এই নিয়মের ফলে শিল্প খাত কয়েক মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়বে।

দিল্লির নেহরু প্লেসের এক সিসিটিভি বিক্রেতা সাগর শর্মা বলেন, এই মাসে ক্যামেরা বিক্রি গত মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এখন বড় অর্ডার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সিসিটিভি বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে এর বাজার প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশই আসে চীন থেকে। চীনের হিকভিশন ও দাহুয়ার মার্কেট শেয়ার ৩০ শতাংশ এবং ভারতের সিপি প্লাসের শেয়ার ৪৮ শতাংশ।

এদিকে, হানহোয়া, মটোরোলা ও যুক্তরাজ্যের নর্ডেন কমিউনিকেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, নতুন নিয়ম অনুযায়ী তাদের ৬ হাজার ক্যামেরা মডেলের খুব কমসংখ্যকই এখন পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে হিকভিশন ও দাহুয়ার যন্ত্রপাতি বিক্রি নিষিদ্ধ করে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াও চীনা যন্ত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ভারতের কর্মকর্তারাও বলছেন, যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ, চিপসেট—সবই পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। কারণ, চীন এ ব্যাপারে অন্যতম প্রধান উদ্বেগের কারণ।

চীনের শাওমি গত মাসে জানায়, তাদের কিছু যন্ত্রের অনুমোদন আটকে আছে কারণ কর্তৃপক্ষ বলেছে, সীমান্তবর্তী দেশ থেকে আসা পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তথ্য জমা দিতে হয়। যদিও সরকারি নিয়মে এমন কিছু উল্লেখ নেই।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিরোধিতা করে তারা এবং আশা করে ভারত ন্যায্য ও বৈষম্যহীন পরিবেশ দেবে।

বর্তমানে ভারতের সরকার ও বেসরকারি খাতে লাখ লাখ সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে ব্যবহৃত হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, বাকিটা ব্যবহার করে শিল্প, বাণিজ্য, হোটেল ও সাধারণ পরিবার।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ক্যামেরাগুলোতে ট্যাম্পার-প্রুফ কাঠামো, শক্তিশালী ম্যালওয়্যার সনাক্তকরণ ব্যবস্থা ও এনক্রিপশন থাকতে হবে। নির্মাতাদেরকে তাদের ক্যামেরার সোর্স কোড বিশ্লেষণের রিপোর্টও জমা দিতে হবে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২৮ মে পর্যন্ত ৩৪২টি আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩৫টির পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে একটি মাত্র ছিল বিদেশি নির্মাতার।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Khaled Hossain

জনপ্রিয় খবর

বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনে, শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের শুভেচ্ছা

চীনা নজরদারি নিয়ে ভারতের উদ্বেগে সিসিটিভি শিল্পে অস্থিরতা

Update Time : ০৬:৩৫:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

বিশ্বজুড়ে নজরদারি প্রযুক্তি নির্মাতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত। এর মূলে রয়েছে একটি নতুন নিরাপত্তা নীতি। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সিসিটিভি নির্মাতাদের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সোর্স কোড ভারত সরকারের পরীক্ষাগারে জমা দিতে হবে অনুমোদনের জন্য। বিষয়টি নিয়ে বৈশ্বিক সিসিটিভি বাজারে তৈরি হয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা।

ভারতের এ পদক্ষেপ মূলত চীনা প্রযুক্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ থেকেই এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ ভারতীয় নীতিনির্ধারক। রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২১ সালে ভারতের তৎকালীন আইটি প্রতিমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত ১০ লাখ সিসিটিভির বেশিরভাগই ছিল চীনা কোম্পানির এবং ভিডিও তথ্য বিদেশি সার্ভারে পাঠানোয় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল।

চলতি বছরের ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন নিয়ম অনুযায়ী, চীনের হিকভিশন, দাহুয়া ও শাওমি, দক্ষিণ কোরিয়ার হানহোয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মটোরোলা সল্যুশনসসহ সব নির্মাতাকে ভারতের পরীক্ষাগারে ক্যামেরা জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। এটি সব ধরনের ইন্টারনেট-সংযুক্ত ক্যামেরার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ভারতের সাবেক সাইবার নিরাপত্তা প্রধান গুলশন রাই রয়টার্সকে বলেন, ইন্টারনেট-সংযুক্ত সিসিটিভি ক্যামেরা দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ঝুঁকি সবসময় থেকেই যায়। সেগুলো যথেষ্ট সুরক্ষিত ও শক্তপোক্ত না হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতের কর্মকর্তারা দেশি-বিদেশি ১৭টি নজরদারি প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে হানহোয়া, মটোরোলা, বোশ, হানিওয়েল ও শাওমির প্রতিনিধিরা জানান, তারা নতুন নিয়মের জন্য প্রস্তুত নন এবং বাস্তবায়ন বিলম্বিত করার অনুরোধ করেন। তবে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি একটি বাস্তব নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যু এবং সময়ক্ষেপণ করা যাবে না।

ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, এই নিয়ম কোনও নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে নয়। বরং দেশের নজরদারি ব্যবস্থার গুণমান ও সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নির্মাতাদের অভিযোগ—পর্যাপ্ত পরীক্ষাগার না থাকা, কারখানা পরিদর্শনে বিলম্ব এবং সোর্স কোড পর্যালোচনার জটিলতার কারণে অনুমোদন পেতে বিলম্ব হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

হানহোয়ার দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক অজয় দুবে ৯ এপ্রিল মন্ত্রণালয়কে এক ই-মেইলে লিখেছেন, এই নিয়মের ফলে শিল্প খাত কয়েক মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়বে।

দিল্লির নেহরু প্লেসের এক সিসিটিভি বিক্রেতা সাগর শর্মা বলেন, এই মাসে ক্যামেরা বিক্রি গত মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এখন বড় অর্ডার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সিসিটিভি বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে এর বাজার প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশই আসে চীন থেকে। চীনের হিকভিশন ও দাহুয়ার মার্কেট শেয়ার ৩০ শতাংশ এবং ভারতের সিপি প্লাসের শেয়ার ৪৮ শতাংশ।

এদিকে, হানহোয়া, মটোরোলা ও যুক্তরাজ্যের নর্ডেন কমিউনিকেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, নতুন নিয়ম অনুযায়ী তাদের ৬ হাজার ক্যামেরা মডেলের খুব কমসংখ্যকই এখন পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে হিকভিশন ও দাহুয়ার যন্ত্রপাতি বিক্রি নিষিদ্ধ করে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াও চীনা যন্ত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ভারতের কর্মকর্তারাও বলছেন, যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ, চিপসেট—সবই পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। কারণ, চীন এ ব্যাপারে অন্যতম প্রধান উদ্বেগের কারণ।

চীনের শাওমি গত মাসে জানায়, তাদের কিছু যন্ত্রের অনুমোদন আটকে আছে কারণ কর্তৃপক্ষ বলেছে, সীমান্তবর্তী দেশ থেকে আসা পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তথ্য জমা দিতে হয়। যদিও সরকারি নিয়মে এমন কিছু উল্লেখ নেই।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিরোধিতা করে তারা এবং আশা করে ভারত ন্যায্য ও বৈষম্যহীন পরিবেশ দেবে।

বর্তমানে ভারতের সরকার ও বেসরকারি খাতে লাখ লাখ সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে ব্যবহৃত হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, বাকিটা ব্যবহার করে শিল্প, বাণিজ্য, হোটেল ও সাধারণ পরিবার।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ক্যামেরাগুলোতে ট্যাম্পার-প্রুফ কাঠামো, শক্তিশালী ম্যালওয়্যার সনাক্তকরণ ব্যবস্থা ও এনক্রিপশন থাকতে হবে। নির্মাতাদেরকে তাদের ক্যামেরার সোর্স কোড বিশ্লেষণের রিপোর্টও জমা দিতে হবে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২৮ মে পর্যন্ত ৩৪২টি আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩৫টির পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে একটি মাত্র ছিল বিদেশি নির্মাতার।