উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর রবীন্দ্রযুগে বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী লেখক প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)। তিনি ‘বীরবল’ ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। সবিশেষ খ্যাত ছিলেন যুগান্তকারী সাহিত্য সাময়িকী সবুজপত্র (১৯১৪)-এর সম্পাদক হিসেবে। তাঁর খ্যাতির অন্যতম কারণ ‘বীরবলী গদ্য স্টাইল’ এবং বয়োকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ‘রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাববিস্তার’।
মনীষীপ্রতিম প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যভাবনা ও ভাষাদর্শ পর্যবেক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা সমালোচনাকর্মের অন্তর্গত প্রয়োজনেই সম্পন্ন হতে পারে। প্রতিটি যুগে অতীতের সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মের পুনর্মূল্যায়ন মানবীয় চিন্তা-গবেষণা-আলোচনা-সমালোচনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। টি এস এলিয়ট বলেন, From time to time, every hundred years or so, it is desirable that some critic shall appear to review the past of our literature and set the poets and the poems in a new order. This task is not one of revolution but of readjustment.
বিশ্বভারতী-প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৬৮) সংকলনে সাহিত্য ও ভাষার কথা, ভারতবর্ষ, সমাজ ও বিচিত্র শিরোনামে অনেক প্রবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সাহিত্য ও ভাষার কথাবিষয়ক প্রবন্ধগুচ্ছের ভিত্তিতে প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যভাবনা ও ভাষাদর্শের বৈশিষ্ট্য আলোচনা এ-প্রবন্ধের মৌল প্রতিপাদ্য।
১.২
সাহিত্য-সাধনার কালগত পরিধি বিচারে প্রমথ চৌধুরীর রচনাসম্ভার সুবিশাল নয়। তবে তাঁর রচনাসম্ভার বিষয়বৈচিত্র্যে বিপুল। ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়েনি তাঁর আলোচনা থেকে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবস্থান ও অবদান সম্পর্কে আলোচনা তুলনামূলকভাবে কম হলেও বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ ও পূর্ণাঙ্গ পুস্তক অনেকে রচনা করেছেন। সেই সব প্রবন্ধ ও পুস্তকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – বুদ্ধদেব বসুর প্রমথ চৌধুরী ও বাংলা গদ্য (১৯৩৮), প্রমথ চৌধুরী (১৯৪৬); ভূদেব চৌধুরীর গদ্যশিল্পী প্রমথ চৌধুরী; শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরবলী গল্প; নীলরতন সেনের প্রমথ চৌধুরী : সাহিত্য প্রবন্ধ প্রসঙ্গ; অতুলচন্দ্র গুপ্তের প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ; দিলীপকুমারের প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র; মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমানের প্রমথ চৌধুরী : বাংলা ভাষা ও গদ্যচিন্তা এবং অধ্যাপক আহমদ কবির-রচিত প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা প্রভৃতি। পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের মধ্যে জীবেন্দ্র সিংহ রায়ের প্রমথ চৌধুরী (১৯৫৪), রথীন্দ্রনাথ রায়ের বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী (১৯৫৮), অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের বীরবল ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬০) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. ক্ষেত্রগুপ্ত, মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান এবং কাজী দীন মুহম্মদ ও ড. সাইদউর রহমান রচিত সাহিত্য সংস্কৃতির উদার প্রান্তরে (ঢাকা, ২০০২) প্রমুখ প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা ও ভাষাবোধের উপর আলোকপাত করেন। ওই আলোচকবৃন্দের মন্তব্যে ও বক্তব্যে বিশ শতকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান স্বীকৃত ও অবস্থান নির্ণীত হয়ে গেছে উত্তমরূপে। তথাপি একজন মনস্বী মনীষী প্রমথ চৌধুরীর সৃষ্টিকর্ম (টেক্সট) সমকালীন যুগের উদীয়মান ভাবনাসূত্রযোগে পাঠ করার অবকাশ থেকে যায়। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সাল থেকে ‘বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য’ নামে যে নতুন যুগবিভাগ শুরু হয়, তাতে বাঙালির স্বাধীন জাতিসত্তা বিনির্মাণে অতীতের ভাবসম্পদ বিরাঁ উদ্দীপক শক্তি। প্রাতঃস্মরণীয় সুসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী আমাদের আত্মগত মননজীবনের ভাব ও ভাষাসম্পদে শ্রীবৃদ্ধিকরণে
অবশ্য-অধ্যয়ন ও অনুধাবনের বিষয়। স্বাধীন জাতির সৃজনশীল ও মননশীল চিন্তারীতি সমৃদ্ধিকল্পে প্রমথ চৌধুরীর
সাহিত্য-ভাবনা ও ভাষারীতি পর্যালোচনা একটি প্রয়োজনীয় কাজ।
১.৩
নিজের লেখক সত্তার পরিচয় প্রদান করতে প্রমথ চৌধুরী সম্রাট আকবরের সভাসদ বীরবলের নামটি ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক চরিত্র এই বীরবলের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, পরিহাস নৈপুণ্য, প্রখর কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিনিষ্ঠা প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচর্চায় প্রতিফলিত হয়। বাংলা সাহিত্যে এসব গুণের সন্নিবেশ যিনি ঘটিয়েছেন তিনিই ‘বীরবল’ ওরফে প্রমথ চৌধুরী। এটুকু হলো তাঁর বীরবল ছদ্মনাম গ্রহণের তাৎপর্য। প্রমথ চৌধুরীর জন্ম যশোরে, বেড়ে ওঠেন কৃষ্ণনগরে। বিদ্যার্জন উপলক্ষে তাঁর যৌবন কাটে কলকাতা ও বিলেতে। বার্ধক্য কেটেছে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে। তাঁর ব্যাপারে অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোন বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রানী ভিক্টোরিয়া-শাসিত ভারত সাম্রাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিস এর এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। একাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তাঁর অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিলো। তিনি রাজলেখক।’
১.৪ স্বকীয়তার উৎস