কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় দ্বায়িত্বরত দুজন লাইফ গার্ড কর্মী।
বঙ্গোপসাগরের নীল জলে গা ভাসাতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় করেন কক্সবাজার সৈকতে। এর মধ্যে কখনো বিশাল সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের টানে কেউ ভেসে যান দূরে, কখনো আটকে পড়েন গভীর স্রোতে। এমন বিপদে তাদের সহায় হয়ে ওঠেন ‘লাইফ গার্ড’ নামের কিছু মানুষ।
অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অচেনা মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে যান তারা। তাদের প্রতিটি ছুটে যাওয়া মানেই যেন একটি নতুন জীবন ফিরে পাওয়া। তবে কক্সবাজারের সৈকতে জীবন বাঁচাতে তাদের এই ছুটে চলা থমকে যেতে বসেছে।
কারণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় লাল-হলুদ পোশাক গায়ে সৈকতের বালুতটে ‘প্রাণরক্ষক’ হয়ে থাকা মানুষগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চলতি মাসেই।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ‘সি সেইফ লাইফগার্ড’ এর ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “আমাদের কাছে যে অর্থ রয়েছে তাতে কেবল সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া যাবে প্রকল্পকে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “কত ঝুঁকি নিয়ে আমরা মানুষের জীবন বাঁচাই, সেটা কেউ জানে না। এখন যদি আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সাগরে মৃত্যুর মিছিল থামানোর কেউ থাকবে না।”

তিনি জানান, কক্সবাজার সৈকতে জরুরি এ সেবাপ্রদান শুরু হয় ২০১২ সালে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে রয়াল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট (আরএনএলআই)-এর অর্থায়নে ‘সি সেইফ লাইফগার্ড’ নামে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
তখন থেকেই দক্ষ ২৭ জন কর্মী বিভিন্ন শিফটে সৈকতে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিটি ঢেউয়ের আড়ালে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন তারা; কেউ বিপদগ্রস্ত হলেই হাতে ভাসমান উদ্ধার সরঞ্জাম নিয়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
লাইফগার্ড কর্মীরা বলছেন, সৈকতের বালুতটে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও প্রাণ বাঁচানো তাদের পেশা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার কারণে লাইফগার্ডিং তাদের নেশায় পরিণত হয়েছে। তাদের বিকল্প কোনো আয়ের উৎসও নেই। ফলে কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হওয়ায় জীবন-জীবিকা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
সি সেইফ লাইফগার্ডের জ্যেষ্ঠ কর্মী মো. ওসমান আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের প্রত্যেকের ঘরে পাঁচ-সাত জন করে সদস্য রয়েছে। বেশিরভাগেরই আয়ের একমাত্র উৎস এই লাইফগার্ড সেবা দেওয়া। তাই অর্থের অভাবে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের পরিবারগুলোতেও সংকট নেমে আসবে।”
সৈকতে সতর্ক অবস্থান নিয়ে প্রতিটি ঢেউয়ের আড়ালে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন লাইফ গার্ড কর্মীরা।
লামা থেকে এসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লাইফ গার্ড সেবায় যুক্ত হয়েছেন আবরাম ত্রিপুরা। তিনি বলেন, “আমি পাহাড়ি ছেলে, পাহাড় থেকে সমুদ্রে এসে মানুষের জন্য কাজ করতে পারায় আমি গর্ববোধ করি। একটা মানুষ ডুবে যাচ্ছে, বিপদে পড়ছে দেখলে আমরা নিজেরা না ছুটে পারি না।
সৈকতে-সাগরে জননিরাপত্তার প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন পর্যটক-স্থানীয়রাও।
তারা বলছেন, লাইফগার্ড কর্মীরা থাকার পরও মাঝে মধ্যে সাগরে গোসলে নামা পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। যেখানে জনবল বাড়িয়ে নিরাপত্তার জোরদার করার কথা সেখানে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে প্রতিদিনই মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হবে।
নোয়াখালী থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে আসা ইনজামামুল হক বলেন, “আমরা সমুদ্রে নামি নিশ্চিন্তে, কারণ জানি লাইফগার্ড আছে। তারা না থাকলে পরিবার নিয়ে আর নামতেই পারবো না। এই কার্যক্রম কখনো বন্ধ হওয়া উচিত না।”

ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আরিফুল হক বলেন, “আমাদের পরিবার-সন্তানদের নিয়ে সৈকতে আসি। লাইফগার্ডদের জন্যই সাহস পাই সমুদ্রে নামতে। তাদের ছাড়া এই সৈকত আমাদের কাছে আর নিরাপদ থাকবে না।”
সি সেইফ লাইফ গার্ডের তথ্যমতে, গত এক বছরে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন পর্যটক। আর মারাত্মক বিপদগ্রস্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৭৮ জনকে। গত এক দশকে মারা গেছেন ৬৫ জন, আর তাদের উদ্ধার তৎপরতায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন ৮০৭ জন।
রয়াল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউটের (আরএনএলআই) প্রকল্পটির ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গত ১১ বছর ধরে ‘সি সেইফ লাইফগার্ড’ সংস্থাটি প্রকল্পাধীন কার্যক্রমের মাধ্যমে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। গতবছর ডিসেম্বরেই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু জেলা প্রশাসনের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রথমে ছয় মাস বাড়িয়ে জুন পর্যন্ত এবং পরে আরও তিন মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
তিনি আরও জানান, প্রকল্পটির বাৎসরিক ব্যয় প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। বর্তমানে লাইফগার্ড কর্মীদের মাসিক বেতন ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অর্থের যোগান না হলে সেপ্টেম্বর শেষে দীর্ঘদিনের এ লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে যাবে জানিয়ে এবং শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সাগর ও পর্যটকদের নিরাপত্তা রক্ষায় বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে।”
তবে লাইফগার্ড কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে জেলা প্রশাসন, মন্ত্রণালয় ও সচিবালয় পর্যায়ে আন্তরিকতার সঙ্গে যোগাযোগ চলছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) আপেল মাহমুদ বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে সৈকতে লাইফগার্ড সেবা কার্যক্রম অতীব জরুরি। কোনোভাবেই এই সেবা কার্যক্রম বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পটি চালু রাখতে জেলা প্রশাসনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আবেদন জানিয়েছে। শীঘ্রই একটি ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার আশা করছি।”
এদিকে জননিরাপত্তার এই সেবাটি পরিচালনা সরকারি উদ্যোগে না হয়ে বেসরকারিভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে চলা নিয়েও কথা বলেছেন অনেকে।
কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল মন্নান বলেন, “এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা সেবা চলে এনজিও প্রকল্প দিয়ে, তাও বারবার টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে সংবাদ পেতে হয়৷ এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না।
“বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি রয়েছে, তারও উপরে পর্যটন কর্পোরেশন আছে, তারা সেবাটিকে কিভাবে সরকারি অর্থায়নে নির্বিঘ্নে চালু রাখা যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।“